
জীবনানন্দ দাস কেমন কবি ছিলেন ? ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে ১৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের বরিশালে কবি জীবনানন্দ দাশের জন্ম। তার পিতা ছিলেন সত্যানন্দ দাশ, তিনি ছিলেন পেশায় একজন শিক্ষক, ব্রজমোহন স্কুলে তিনি শিক্ষকতা করতেন, এছাড়াও তিনি ব্রাহ্মসমাজের মুখপাত্র ও ব্রহ্মবাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক। মা ছিলেন কুসুমকুমারী দেবী। তিন সন্তানের মধ্যে প্রথম ছিলেন জীবনানন্দ দাশ, জীবনানন্দের পরে জন্মগ্রহণ করেন অশোকানন্দ দাস এবং কন্যা সুচরিতা দাশ। জীবনানন্দ দাশের মা কিন্তু একজন সাহিত্যিক, তার লেখা সেই বিখ্যাত কবিতা_” আমাদের দেশে হবে, সেই ছেলে কবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।
জীবনানন্দ দাস কেমন কবি ছিলেন ?
বাঙালি কবি
|
|
স্থানীয় ভাষায় নাম | জীবনানন্দ দাশ |
---|---|
জন্ম তারিখ | ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯ বরিশাল |
মৃত্যু তারিখ | ২২ অক্টোবর ১৯৫৪ কলকাতা |
নাগরিকত্ব |
|
শিক্ষালাভ করেছেন |
|
নিয়োগকর্তা |
|
মাতৃভাষা |
|
লেখার ভাষা |
|
পিতা |
|
মাতা |
|
উল্লেখযোগ্য কাজ |
|
সারা জীবন আনন্দের সহিত বাঁচবে সেই হল জীবনানন্দ। কিন্তু সারা জীবন কেঁদে গেছেন। শোক তার পিছু ছাড়েনি, তার লেখা সাহিত্যের পাতায় উঠেছে সেই অতৃপ্তি
বাংলা র রুপ সুধা,প্রকৃতি র নির্মলতা, জীবনানন্দের মতো এত সুনিপুণ ভাবে কোনো
কবি,,সাহিত্য ক ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন কি না। আমার জানা নেই।
তাইতো জীবনানন্দ কে চিত্ররুপময় কবি বলে।বাংলার এই রুপ, গভীরভাবে যে আস্বাদন করেছেন,,প্রত্যাকটা বর্ণনায় মাটির, ফুলের,ভেজা
, প্রকৃতি, নিরব প্রকৃতি র যে ছবি জীবনানন্দ একে গেছেন, এক কথায় রুপসী বাংলার রুপ।
তাই তো তাকেঁ রুপসী বাংলার কবি বলা হয়।
জীবনানন্দ দাশ কে বিভিন্ন সাহিত্যক বিভিন্ন ভাবে অভিহিত করেছেন.কেউ বলেছেন চিত্ররুপময় কবি।
★তিমির হননের কবি।
ধুসরতার কবি।
সাহিত্যেক বুদ্ধদেব বসু তাকে নির্জনতম কবি হিসেবে অভিহিত করেছেন।
নীল কন্ঠী কবি।
কালচেতনার কবি।
ইত্যাদি বিভিন্ন নামে তিনি পরিচিত।
জীবনানন্দ দাসের সাহিত্যকর্ম
কাব্যগ্রন্থ
জীবদ্দশায় প্রকাশিত
ঝরা পালক (১৯২৭)
ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬) নির্ঘণ্ট পাতা দেখুন স্ক্যান পড়ুন
বনলতা সেন (১৯৪২) নির্ঘণ্ট পাতা দেখুন স্ক্যান পড়ুন
মহাপৃথিবী (১৯৪৪) নির্ঘণ্ট পাতা দেখুন স্ক্যান পড়ুন
সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮)
মরণোত্তর প্রকাশিত
রূপসী বাংলা (১৯৫৭)
বেলা অবেলা কালবেলা (১৯৬১)
সুদর্শনা (১৯৭৩)
মনোবিহঙ্গম
আলোপৃথিবী
কবিতার কথা
উপন্যাস
মাল্যবান (১৯৭৩)
সুতীর্থ
জলপাইহাটি
কারুবাসনা
নিরুপম যাত্রা
জীবনপ্রণালী
পূর্ণিমা
বাসমতীর উপাখ্যান
প্রেতীনীর রূপকথা
নির্জন নিঃসঙ্গ বিষণ্ন স্তিমিত অবসন্ন-এমনি ধারা বিশেষণে সাজিয়ে এ-ই এতদিন বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে জীবনানন্দ মিশুক নয়, ঠোঁটে আঁকা মৃদু হাসির বাইরে সে হাসতে জানে না, গা ঢেলে আড্ডা দিতে জানে না, রাস্তায় পরিচিত লোক দেখলেই পাশ কাটিয়ে সরে পড়ে। একদল লেখককে বলতে শুনেছি জীবনানন্দ জীবন থেকে পালিয়েছে, আরেক দল বন্ধুদের মুখে কথা, মানুষ থেকে যেন তৃণতরু শূন্য বালির চরের ধারে জনশূন্য নৌকা বাঁধা। অবিশ্যি সূর্যের খাড়া আলোর কাছে এসে সে দাঁড়াতে চায়নি, কনুই দিয়ে ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসা দূরের কথা। ডিঙি মেরেও দাঁড়ায়নি গলা বাড়িয়ে।
জীবনানন্দকে বহুবছর বেকারত্বের দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে দিন কাটাতে হয়েছিল, এর জেরে পরিবারটির আর্থিক দুরবস্থার অন্ত ছিল না। হয়তো এসব কারণেই লাবণ্যের খিটিমিটি আর জীবনানন্দের হতাশাবোধ। আর এ ভাবুক কবির সঙ্গে লাবণ্য হয়তো তল খুঁজতে খুঁজতেই দিশাহারা থাকতেন। তাই কাঁদতেন। কে বলতে পারে!
এদিকে জীবনানন্দ সম্পর্কের এতসব জটিলতায় হার্টফেল করে বসেন কি না তা ভাবছেন, এমনকি আত্মহত্যা করার চিন্তাও রয়েছে। ভুক্তির শেষের ফুটনোটটি করুন আলো বিকীরণ করে বলছে, ভবিষ্যতের পৃথিবী এ অনভিপ্রেত বিষয়গুলোর মীমাংসা কীভাবে করবে!
তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’কে জীবনানন্দ এক প্রকার নাকচ করে দিয়েছিলেন, পরের বইয়ের ভূমিকায় সেটি স্পষ্ট করে লিখেও দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ধূসর পাণ্ডুুলিপি’ থেকেই মূলত তার কবিতার স্বতন্ত্র ধারা সবার চোখে পড়ে। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র ‘নির্জন স্বাক্ষর’, ‘সহজ’ ইত্যাদি কবিতায় তার হারিয়ে যাওয়া প্রেমকে বেশি করে খুঁজে পাওয়া যায়। ‘নির্জন স্বাক্ষর’ কবিতার প্রথম দুটি লাইন-
তুমি তা জান না কিছু,- না জানিলে,-
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ করে!
এ প্রেমটা নিয়ে তিনি যে কত ঝামেলায় ছিলেন, সেটি তার জীবন এবং সাহিত্য নিয়ে যিনি বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ করে গেছেন, সেই ভূমেন্দ্র গুহের জবানীতে শোনা যাক।
‘এই প্রেমটারও যে অসার্থকতা ছাড়া আর কোনো পরিণতি থাকতে পারত না, তা জীবনানন্দ বুঝতেন নিশ্চয়ই, তবু তিনি ঘটনাটাকে এড়িয়ে যেতে পারেননি, বরং খুব বেশি ভাবে পাকে-পাকে জড়িয়ে পড়েছিলেন, এবং নিজেকে জড়িয়ে থাকতে দিয়েছিলেন হতাশায় ক্ষোভে ক্রোধে বিষণ্নতায় ও অবাস্তব ব্যর্থতাবোধে ভুগতে-ভুগতে…।’ (দিনলিপি ৩য় খণ্ড/ ভূমেন্দ্র গুহ/পৃ. ১১৬৫)।
জীবনানন্দের মৃত্যুর পর প্রকাশিত গল্প-উপন্যাসের বেশিরভাগ ছিল আত্মজৈবনিক। তার লেখা প্রথম উপন্যাস ‘মাল্যবান’ প্রকাশে লাবণ্য দাশ বাধা দিয়েছিলেন। কী ছিল ‘মাল্যবান’-এ, যা ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হতে দিতে লাবণ্যের আপত্তি ছিল!
সমালোচকরা বলেন, এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র মাল্যবানের মাধ্যমে জীবনানন্দ তার নিজের অসুখী দাম্পত্য সম্পর্কের কথাই লিখে গেছেন।
উপন্যাসে মাল্যবানের স্ত্রীর নাম উৎপলা। মাল্যবান যাকে পলা নামে ডাকে। উৎপলা সুন্দরী, রাগী এবং খরুচে। অন্যদিকে মাল্যবান গরিব, সাধাসিধে, শান্ত। দেখতে সে অনাকর্ষণীয়ও বটে।
স্ত্রীর অবহেলায় বাড়ির নিচতলার স্যাঁতসেঁতে ঘরে একা একা রাত্রিবাস করে মাল্যবান। উৎপলার কাছে ভিড়তে চাইলে শুনতে হয় নানা গঞ্জনা। বাড়িতে উৎপলার ভাই এসেছে, থাকার অসুবিধা মেটাতে মাল্যবানকেই বাড়ি ছাড়তে হয়। সাত মাস মেসবাড়িতে কাটিয়ে আসে মাল্যবান। উৎপলার বন্ধু আসে-যায়, মাল্যবান বুঝতে পারে কী হচ্ছে। স্ত্রীর কাছে তার কোনো মর্যাদা নেই। বন্ধুবেষ্টিত উৎপলার অবহেলা সহ্য করতে করতে যেন নির্জীব হয়ে যায় মাল্যবান।
মাল্যবান একা-একা স্মৃতির মধ্যে ঘুরপাক খায়। পৌষের শীতের রাত, গ্রামের ছোট নদী, কাক আর কোকিলের আসা-যাওয়া কল্পনা করে। মাল্যবানের জন্মদিনে কেউ তাকে মনে রাখে না। মাল্যবানের বয়স বাড়ে, আরেকটি জন্মদিন অবহেলায় অপসৃত হয়ে যায়।
‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ থেকে ‘বনলতা সেন’, এরপর ‘মহাপৃথিবী’ এবং ‘সাতটি তারার তিমির’। একটির পর একটি কাব্যগ্রন্থে তিনি নিজেকে ছাড়িয়ে যান। ততদিনে তার অনেক সুহৃদ, আপনজনরা তাকে ছেড়ে গেছেন। তার কবিতা দুর্বোধ্য হয়ে পড়েছে-এটাই ছিল তাদের অভিযোগ। কিন্তু তবু তিনি নিজের প্রতিভার ওপর আস্থা রেখেছেন। আস্থা যে রাখতে হয় সেটি তিনি তার প্রবন্ধেও স্পষ্ট করেছেন।
বলেছেন, শেষ পর্যন্ত কবিকে প্রতিভার কাছে বিশ্বস্ত থাকতে হবে। হয়তো কোনো একদিন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতার সঙ্গে তার কবিতা মূল্যায়িত হবে। চরাচরের সব জীবের হৃদয়ে মৃত্যুহীন স্বর্ণগর্ভ ফসলের খেতে বুননের জন্য দরকার পড়বে সেই বিশেষ কবিতার।
আজ এত বছর পর কি এ কথাগুলো প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে না?
সবকিছু ছাপিয়ে জীবনানন্দ দাশ এবং বাংলা কবিতা একে অন্যকে জড়াজড়ি করেই আজ ইতিহাস। তিনি চলে গিয়েও তাই আছেন। ধানসিঁড়ি নদী, হোগলা, নিম, সজনে, ধুন্দলকে কবিতার অনুষঙ্গ করে ‘রূপসী বাংলা’র কবি এ বাংলায় রয়ে গেছেন, তার সব নির্জনতা নিয়ে।