ডাকসু নির্বাচনের কী প্রভাব পড়বে জাতীয় নির্বাচনে?

ডাকসু নির্বাচনের কী প্রভাব পড়বে জাতীয় নির্বাচনে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র-ছাত্রী সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনের প্রভাব জাতীয় রাজনীতিতে কতখানি প্রভাব ফেলবে, এ নিয়ে আলোচনা আছে রাজনীতিতে। আগামী ৯ সেপ্টেম্বর ডাকসু ও হলগুলোর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এর প্রভাব আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও পড়বে- এমন সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন সক্রিয় রাজনীতিকরা। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের বিগত ১৫ বছরের একতরফা শাসনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বাধীন সংস্কার কার্যক্রম চলমান অবস্থায় এই নির্বাচনকে জাতীয় নির্বাচনের একটি ‘টেস্ট কেস’ বলেই দেখছেন রাজনীতিকরা।
যদিও কোনও কোনও প্রবীণ রাজনীতিক মনে করেন, জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে ডাকসু নির্বাচন তুলনীয় নয়। কেবল একটি প্রতিষ্ঠানই নয়, সারা দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের স্বার্থ দেখার জন্য নেতৃত্ব দরকার এবং সেটি কেবল ক্যাম্পাস ও পড়াশোনার উন্নতির জন্য দরকারি। এক্ষেত্রে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ওপর জোর দেন।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, রাজনৈতিক দলগুলোর মূল নজর রয়েছে ডাকসু নির্বাচনের ওপর। ইতোমধ্যে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি, সিপিবি, ইসলামী আন্দোলন, গণসংহতি আন্দোলন, নাগরিক ঐক্য, গণঅধিকার পরিষদসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ ছাত্রদের নির্বাচন পরিচালনা করতে তত্ত্বাবধানে যুক্ত করেছেন দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের।
বিএনপির একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র দাবি করেছে, শীর্ষ নেতৃত্ব সরাসরি ডাকসু নির্বাচনের ভালো-মন্দ আপডেট রাখছেন।
ছাত্র শিবিরের একজন নেতা জানান, শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতারা ডাকসু নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করতে পরিকল্পনা করছেন এবং মাঠ পর্যায়ে তা বাস্তবায়নের রূপরেখা নিশ্চিত করছেন।
গত বুধ (৪ সেপ্টেম্বর) ও বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকা, বিশেষ করে চানখাঁরপুল, নাজিরাবাজার, নীলক্ষেতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রভাবশালী অন্তত তিনটি পক্ষ ছাত্রদের খাবার-দাবার নিশ্চিত করতে হোটেলগুলোতে ব্যাপক খরচ করছেন। কোনও কোনও সংগঠন সুনির্দিষ্টভাবে বাজেটও পরিচালনা করছে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। এই খরচ জোগানের পেছনে অভিভাবক সংগঠনগুলোর অবদান রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠার পর ঢাবির প্রথম কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের ভোট হয় ১৯২৪ সালে। এই সময় পর্যন্ত ৩৭ বার নির্বাচন হয়েছে ডাকসুর। এর মধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর হয়েছে সাতবার। সর্বশেষ ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচন হয়। ওই নির্বাচনে সহ-সভাপতি পদে বিজয়ী হন নুরুল হক নুর, যিনি বর্তমানে গণঅধিকার পরিষদ নামে একটি দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৮ সালে কোটাবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আলোচনায় এসেছিলেন নুর।
আগামী ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠেয় ডাকসু নির্বাচনে গত বছর শেখ হাসিনার পতনের আন্দোলনে সক্রিয় ছাত্র-ছাত্রীরা বেশি আলোচনায়। সবগুলো পক্ষই অভ্যুত্থানে সক্রিয়দের সামনে রেখে প্যানেল সাজিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেল, বামপন্থি কয়েকটি সংগঠনের সমন্বয়ে ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’, ছাত্র শিবিরের ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের ‘বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ’, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন সমর্থিত বিনির্মাণ পর্ষদ (আংশিক), সমন্বিত শিক্ষার্থী সংসদ, উমামা ফাতেমার নেতৃত্বাধীন ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য’, ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের প্যানেল, ছাত্র অধিকার পরিষদের ‘ডাকসু ফর চেঞ্জ’ প্যানেল, ‘অপরাজেয় ৭১-অদম্য ২৪’ প্যানেল।
এই প্যানেলগুলোর প্রত্যেকেই কোনও না কোনও দলের প্রভাবে প্রভাবিত। তবে কোনও কোনও পক্ষ স্বতন্ত্র হিসেবে প্রকাশ্যে থাকলেও নেপথ্যে প্রভাবশালী একাধিক গোষ্ঠীও রয়েছে বলে ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতারা জানান।
ডাকসুতে বিভিন্ন সময় নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন, বর্তমানে মূলধারার রাজনীতিতে সক্রিয় নেতারা বলছেন, জাতীয় নির্বাচন প্রতি পাঁচ বছর অন্তর আসে। অন্যদিকে ডাকসুসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন নিয়মিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। বিশেষ করে এখন থেকে প্রতিবছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রনেতৃত্ব ধারাবাহিক রাখার জন্য নিয়মিত নির্বাচনের বিকল্প নেই বলে জানান তারা।
কোনও নেতার ভাষ্য, পাকিস্তান আমল থেকে তৎকালীন স্বৈরশাসনের প্রতিবাদ, গণঅভ্যুত্থান, ভাষা আন্দোলন, একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে ডাকসুর নেতৃত্ব অসাধারণ ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে স্বাধীনতার আগে-পরে ডাকসু গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে দেশের সামনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠে। একসময় ডাকসু নির্বাচনের দিকে সারা দেশের চোখ থাকতো।
ডাকসুর সাবেক দুইবারের ভিপি (৭৯-৮০ ও ৮০-৮১ সেশন) মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘আমি যখন নির্বাচন করেছি, তখন আমার সঙ্গে ওবায়দুল কাদেরের (আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক) প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। তখন তো আসলে ব্যাপারটা ছিল দলকেন্দ্রিক।’
তিনি উল্লেখ করেন, ‘সারা দেশে ডাকসু নির্বাচনের আমেজ ও উদ্দীপনা ছিল। পুরো বাংলাদেশ সে সময় ডাকসু নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে ছিল। তখন ডাকসু নির্বাচন মানে জাতীয়ভাবে দলের জয় পরাজয়। কিন্তু এখন তেমন দেখছি না।’
ডাকসু নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনে কতখানি প্রভাব ফেলবে, এমন প্রশ্নের জবাবে মান্না বলেন, ‘না, আমার মনে হয় না এবার তেমন প্রভাব ফেলবে।’
১৯৭২-৭৩ ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। সিপিবির সাবেক এই সভাপতি বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচন একটি বড় ইস্যু। সেটার অক্সিলারি একটা কাজ হচ্ছে ডাকসু–এভাবে দেখার পক্ষপাতি আমি না। জাতীয় নির্বাচন তো প্রত্যেক বছর হবে না। কিন্তু ডাকসু নির্বাচন হবে প্রতিবছর। শুধু ডাকসু নয়, প্রত্যেকটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিবছর নিয়মিত নির্বাচন হওয়া উচিত।’
তিনি বলেন, ‘প্রত্যেকটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকবে, যেভাবে সমাজের অন্যান্য পেশার মধ্যেও রয়েছে। তাদের সুখ-দুঃখ, অভাব-অভিযোগ, কামনা বাসনা এবং ক্রিয়েটিভ এফোর্টগুলোকে সংগঠিত করার জন্য যে সংস্থা দরকার, যেটা উকিলের আছে, ডাক্তারের আছে, ইঞ্জিনিয়ারের আছে, এমনকি লুটেরা ধনিক শ্রমিকেরও আছে, গার্মেন্টসের লুটেরাদেরও আছে, সবারই আছে। আমি বিষয়টিকে এভাবে দেখি।’
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘এখন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে যারা নাকি এটাকে ইন্স্ট্রুমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করতে চায়- ছাত্ররা রাজনীতিতে ইনভলভ হয় তাদের নিজস্ব ইস্যুতে, ছাত্রজীবনের বাস্তবতার কারণেই তাদের রাজনীতিতে ইনভলভ হতে হবে; এসব বিষয় কিন্তু চলে আসে। এভাবে ইনভলভ থাকতে পারে।’
‘কিন্তু শুধু ছাত্রদের ভেতর থেকে নেতা হবে, এমনটা সঠিক না। খালি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই নেতা হবে? কৃষক, শ্রমিক, অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নেতা হবে না’- প্রশ্ন রাখেন ডাকসুর এই সাবেক ভিপি।
পরীক্ষার তারিখের মতোই ডাকসু নির্বাচনের তারিখ অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডারে থাকতে হবে, এমন আশাবাদ রেখে সেলিম বলেন, ‘প্রতিবছর এটা নিয়মিত হবে এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের এমন ভয়েস যেন উঠে আসে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র-ছাত্রী সংসদের (ডাকসু) সাবেক ভিপি আমানউল্লাহ আমান মনে করেন, ‘ডাকসু হচ্ছে দেশের দ্বিতীয় সংসদ।’ তিনি বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচন প্রতিবছরই হওয়া উচিত এবং ডাকসু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জাতীয় নেতৃত্ব গড়ে ওঠে।’
১৯৯০-৯১ সেশনে ডাকসুর এই ভিপি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কারিকুলাম, বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক খেলাধুলাসহ নানান সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে ছাত্র প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে হলে সবচেয়ে ভালো হয়। শুধু তাই নয়, জাতীয় রাজনীতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এবং জাতীয়ভাবে যেকোনও বিষয়ে কথা বলার অধিকার থাকতে হবে ডাকসুর নেতৃত্বের। তারা কথা বলবে, তাদের কথা বলতে হবে যেকোনও প্রয়োজনে। যেকোনও ক্রান্তিকালে ডাকসুকে আগে আসতে হবে এবং অতীতে সেটা হয়েছে। অতীতের ইতিহাস বলে আগামীতেও সেভাবে হওয়া উচিত।’
তবে কোনও কোনও নেতা স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো ছাত্র শিবিরের ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত বলে জানিয়েছেন। বিশেষ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে সংগঠনটির অভিভাবক দল-জামায়াতে ইসলামীর সরাসরি সাংগঠনিক বিরোধিতা, ছাত্র সংঘের স্বাধীনতার বিরোধিতার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতির অবনতি হয় কিনা, এমন আশঙ্কাও রয়েছে দাবি করেন কেউ।
যদিও ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, গত জুলাই অভ্যুত্থানে শিবিরের অংশগ্রহণ থাকলেও সামনের সারির প্রার্থীরা বর্তমানে ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষিত ছাত্রলীগে গুপ্ত অবস্থায় থাকার কারণে ব্যালটে এর প্রভাব পড়তে পারে।